ভিতরে

ঐতিহ্যের কলের গানে নিজেরে হারায়ে খোঁজেন নাটোরের আরশাদ

নিখুঁত শব্দে মুগ্ধ হওয়ার দিনগুলোতে একসময় কলের গানই ছিল একমাত্র মাধ্যম। গানের মাস্টার ভয়েস বলতে কলের গান বা গ্রামোফোনকেই বোঝায়। চল্লিশ বছরের বেশী সময় ধরে এ সংগ্রহ এখন রীতিমতো ঈর্ষণীয় সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, কাজী নজরুলের অবিনাশী গানসহ প্রায় দেড় হাজার গ্রামোফোনের সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। এ সংগ্রহশালায় বসে নিজেরে হারায়ে খোঁজেন আরশাদ।
বাগাতিপাড়ার উপজেলার জামনগর এলাকার বাসিন্দা আরশাদ মাহমুদ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে সম্প্রতি অবসরে গেছেন। সত্তর দশকের কৈশোর-তারুণ্যের দূরন্ত দিনগুলোতে হারিয়ে যান তিনি। বলেন, ঐ সময় গানই ছিল আমার প্রাণ। পথে-ঘাটে-প্রান্তরে গান শুনলেই থমকে গেছি। কিভাবে ঐ গানের গ্রামোফোন বা লং প্লেয়িং রেকর্ড (এলপিআর) সংগ্রহ করা যায়।
ঐ সময়ে গ্রামোফোনের লং প্লেয়িং রেকর্ড চালাতে পুরনো দিনের ঘড়ির মত স্প্রিং এর চাবি ব্যবহার করা লাগতো। মাত্র দুইটা গানের জন্যে একটা এলপিআর বাজাতে তিনবার চাবি দেওয়া লাগতো। এরপর আসে বৈদ্যুতিক মোটরের সাহায্যে চলা গ্রমোফোন। প্রথমদিকে এক একটা এলপিআরে থাকতো মাত্র দুইটা গান। এরপর চারটা, শেষে আটটা থেকে বারোটা। প্রথমদিকে এলপিআর মিনিটে ঘুরতো ৭৮ বার অর্থাৎ (৭৮ রেগুলেশন পার মিনিট)। এরপরে ৪৫, শেষে ৩৩ বার।
আরশাদের সংগ্রহে আছে জাপান ও চায়নার দু’টো গ্রামোফোন। গান শোনা, রেডিও ও ক্যাসেট বাজানোর সুবিধা থাকা জাপানের গ্রামোফোন একটা থ্রি-ইন-ওয়ান। এসব গ্রামোফোনের চল বিশ্ব বাজারে আর নেই বললেই চলে। শুধু সীমিত পরিসরে ভারতে এখনো টিকে আছে।
চল না থাকলেও মাস্টার ভয়েস বলতে যা বোঝাই তাই গ্রামোফোন। এমন নিখুঁত শব্দের গান শুধু কলের গানেই পাওয়া সম্ভব। ‘কলের গানে গান শোনা নেশার মত টানে আমাকে’ বললেন আরশাদ। আরশাদের মতে, ‘কলের গানই হচ্ছে প্রকৃত গানের উৎসমূল। অতীতের সোনালী গানের দিনে হারিয়ে যেতে কলের গান তুলনাহীন’। পাশাপাশি আরশাদের কন্ঠে কিছুটা আক্ষেপও ছিল, যথাযথ সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় এলপিআরগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ১৪ মিনিটের ভাষণের এলপিআর ঐ সময় ‘জয় বাংলা’ শিরোনামে ঢাকা রেকর্ড থেকে এবং কলকাতা থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ঢাকা ও কলকাতা সংস্করণের ভাষণ আছে আরশাদের সংগ্রহে। রবি ঠাকুরের স্বকণ্ঠে কৃষ্ণকলি, তবু মনে রেখ কিংবা বীরপুরুষ কবিতা আছে আরশাদের কাছে। আরশাদের কাছে আছে কাজী নজরুলের স্বকন্ঠে পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়, কেন দিতে এলে ফুল আর আছে নারী, রবিহারা কবিতা। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট্রের ২৬টি গান ও কবিতা নিয়ে দু’টোর এলপিআর ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’ আছে আরশাদের সংগ্রহে। 
এলপিআরের পাশাপাশি আরশাদের সংগ্রহে আছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রচারিত এম আর আকতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ এবং শুধু তবলা, হারমোনিয়াম আর বাঁশির সমন্বয়ে গীত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেশীরভাগ দেশাত্ববোধক গানের অডিও। উত্তম-সুচিত্রা’র ৩২টি আলোচিত চলচ্চিত্র এবং ষাট-সত্তর-আশি দশকের চারশ’ বাংলা সিনেমার সিডি বা ডিভিডি। 
গান শোনার পাশাপাশি আরশাদ গান করেনও। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব’এ গান শেখান আরশাদ। তিনি বাগাতিপাড়া শিল্পকলা একাডেমি’র সঙ্গীত প্রশিক্ষক। তাঁর সংগ্রহে আছে অসংখ্য বাংলা গানের ব্যাকরণ, গবেষণা গ্রন্থ আর স্বরলিপি। পনের হাজার বাংলা, উর্দু, হিন্দি গানের সম্ভারে আরশাদের গানের এ সংগ্রহশালা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে। হয়ে উঠেছে অনন্য এক রিসোর্স সেন্টার। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর গানের উৎস সন্ধানে ভবিষ্যতে এ রিসোর্স সেন্টার হয়ে উঠতে পারে বাতিঘর।

আপনি কি মনে করেন?

0 টি পয়েন্ট
উপনোট ডাউনভোট

একটি মন্তব্য

দুইটি বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রদান

এভারটনের কোচ হিসেবে নিয়োগ পেলেন বেনিতেজ