ভিতরে

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু আর না

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবছর ৩,০৩,০০০ (তিন লাখ তিন হাজার) নারীকে গর্ভধারণকালীন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কিংবা প্রসব-পরবর্তী সময়ে সৃস্ট শারীরিক জটিলতায় প্রাণ হারাতে হয়। প্রতি ২ মিনিটে একজন নারী এই মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হচ্ছেন। অথচ একটু সচেতনতাই পারে এই মৃত্যুকে সহজে প্রতিরোধ করতে।
যদি নারীর গর্ভাবস্থা ও প্রসব কালীন উপযুক্ত যত্ন ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। মূলত খিঁচুনি ও প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই বেশির ভাগ নারীর মৃত্যু ঘটে। পাশাপাশি জন্ডিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং শ্বাস কষ্টের কারণেও অনেককে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
নিরাপদ মাতৃত্ব প্রতিটি নারীর অধিকার। এ লক্ষ্যে সরকার দরিদ্র গর্ভবতী মায়েদেও আর্থিক সহায়তার জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। মাতৃত্ব ¡কালীন ভাতা হলো দরিদ্র মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সামাজিক নিরাপত্তা মূলক কার্যক্রম। ২০ বছরের বেশি বয়সের একজন দরিদ্র মা প্রথম এবং দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে ধারণ করলে এই ভাতা পেয়ে থাকেন। এ ভাতামা ও শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ঘাটতি পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে গড়ে ২১ জন করে দরিদ্র মা এই ভাতা পান। ২০০৭ সাল থেকে এই ভাতা প্রদানের সূচনা। মাতৃত্বকালীন ভাতা চালুর সুফল সমূহ কী কী? গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর পুষ্টিকর খাবার প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে, মা ও শিশুমৃত্যুনর মত অনভিপ্রেত করুণ ঘটনা হ্রাস পাচ্ছে, অভিশপ্ত বাল্যবিবাহের হার কমেছে, বিবাহ নিবন্ধন নিশ্চিত হয়েছে।
কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে প্রতি হাজার জীবিত শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১.৭৬ জন মায়ের মৃত্যু হতো। অর্থাৎ বছরে ৫ থেকে ৬ হাজার মাতৃমৃত্যু ঘটতো। এখন আমাদের দেশের নারীদেও মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০১ সালে যেখানে মাত্র ৯% নারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে সন্তান প্রসব করতেন, বর্তমানে তা ৪৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই হার ক্রমবর্ধমান।
একজন সুস্থ মা-ই পারেন একজন সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে। আর একটি সুস্থ সমৃদ্ধ উন্নত জাতি গঠনে সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশু জন্মেও বিকল্প নেই। সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুর জন্ম নিশ্চিত করতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নানাবিধ কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রায় ৮ লক্ষ হত দরিদ্র নারীকে মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি মা মাতৃত্বকালীন ভাতা হিসাবে প্রতি মাসে ৮০০ টাকা করে পাচ্ছেন।
একজন মা ২ বছর পর্যন্ত মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়ে থাকেন। শূন্য হতে ৫ বছরের মধ্যে শিশুর ৯০ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধিত হয়। তাই এ সময় মা ও শিশু উভয়ের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া খুবই জরুরি। এ বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার মাতৃত্বকালীন ভাতার মেয়াদ ২ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩ বছর করার পরিকল্পনা করছে। এছাড়া মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীত করা হয়েছে।
বর্তমানে মায়েদেও সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে প্রসব সেবা নেওয়ার হার আগের চেয়ে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ রক্ত ক্ষরণ এবং খিঁচুনি। জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও মাতৃস্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। স্বাধীনতার পর মোট প্রজনন হার (টিএফআর) ছিল ৬ জন। অর্থাৎ একজন মাতার প্রজনন বয়সে (১৫-৪৯ বছর) গড়ে ছয়টি সন্তানের জন্ম দিতেন। ২০০১ সালে এটা কমে ৩ দশমিক ২ হয়েছে। সর্বশেষ টিএফআর ২ দশমিক ৩।
আইসিডিডিআরবি’র তথ্যে দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকে অপুষ্টির শিকার (বডিমাসইনডেক্স অনুযায়ী) নারী ছিল ৫০ শতাংশ। বর্তমানে ২২ শতাংশ। অর্থাৎ দুই দশকে নারীর সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তবে দেশে এখনও কম ওজন নিয়ে (লোবার্থ ওয়েট) শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এর কারণ মায়ের অপুষ্টি। প্রজনন বয়সে এখন এক তৃতীয়াংশ নারী রক্ত স্বল্পতায় ভুগছেন। প্রতি তিনজন নারীর একজন আয়োডিন স্বল্পতার শিকার। মা আয়োডিনের স্বল্পতায় ভুগলে তার অনিবার্য প্রভাব পড়ে শিশুর ওপর। আয়োডিন মস্তিষ্কেও বিকাশ ঘটায়। ফলে মায়ের ঘাটতির কারণে শিশুর মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে না। শুধু দারিদ্র্যই নয়, অসচেতনতাও অনেকাংশে দায়ী।
শিশু মায়ের গর্ভে থাকাকালীন মায়ের কাছ থেকেই বেশি পুষ্টি নেয়। তখন মায়ের পুষ্টিচ াহিদা বেড়ে যায়। মাকে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ালে মা ও শিশু দু’জনেরই পুষ্টির অভাব দেখা দেবে। ফলে গর্ভেও শিশুর বৃদ্ধি কম হবে, ওজন হবে কম। এই কম ওজনের নাজুক শিশু রোগে আক্রান্ত হয় বেশি। গর্ভাবস্থায় শিশুর পুষ্টির অভাবে মস্তিষ্ক ঠিক মতো গঠন হয় না। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঠিক মতো হয় না। পুষ্টিকর খাবারের অভাবে মায়ের রক্ত স্বল্পতা দেখা দিতেপারে। মাকে তাই স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি ফল মূল, শাক সবজি বেশি কওে খাওয়াতে হবে। এ সময় প্রচুর পানিও পান করতে হবে ।
সপ্তম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা ও রূপকল্প ২০২১-এর আলোকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রণীত পাঁচ বছর মেয়াদি ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচি ২০১৭-২০২২’-এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ি তহলে দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা’র স্বাস্থ্য বিষয়ক সূচকগুলো অর্জনে এ উন্নয়ন কর্মসূচি বিরাট ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে এখন প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, ১০৭টি মেডিকেল কলেজ, ৫ হাজার ১৮২টি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, প্রায় ১০ হাজার ৪০০ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিশেষায়িত হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতাল ৪৬টি, ৪২৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৫ লক্ষাধিক স্বাস্থ্য সেবা দানকারী দেশের সব প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সক্রিয়। এসব বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে একটি মজবুত ও টেকসই কাঠামোর ওপর দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছে। বর্তমান সরকারের এ সাফল্যকে আরো টেকসই করার জন্য আমাদেও প্রত্যেকেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রতিটি মায়ের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত কওে মা ও শিশুকে সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমাদের সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজটি হয়ে উঠবে সহজতর।

আপনি কি মনে করেন?

0 টি পয়েন্ট
উপনোট ডাউনভোট

একটি মন্তব্য

দেশজুড়ে বাড়ছে সূর্যমুখীর আবাদ : শেরপুরে চাষ হচ্ছে ৫শ’ হেক্টর জমিতে

করোনায় হাত ধোয়া ও মাস্ক পরায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে