ভিতরে

একটি ঘর কেবল আশ্রয় নয়, তাদের কাছে ‘সম্মানের প্রতীক’

জন্মের উপর কারও হাত না থাকলেও সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের শিশু এবং তাদের পরিবারকে সহ্য করতে হয় অসহনীয় যন্ত্রণা। অনেক ক্ষেত্রে সমাজ থেকে বিচ্যুত হতে হয় । এসব যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রায় প্রতিটি পরিবারই তাদের কোমলমতি শিশুদের ওপর চালায় নানা ধরনের নির্যাতন, যা ঐ শিশুদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করে।
নিজের পরিবারকে সমাজের কাছে কলঙ্কমুক্ত করতে যে সব শিশুরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘর ছেড়েছে, ১৩ বছর বয়সী ফুল তাদেরই একজন। আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় নিজের পরিবার ছেড়ে উদ্দেশ্যেহীনভাবে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন তিনি।
আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে দেয়া ঘরে বসে বাসস প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ফুল বলেন, ‘আমি আসলে পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক ছোট বয়সেই ঘর ছাড়ি। আমার দোষ ছিলো, আমি ছেলে হয়েও মেয়েদের মতো আচরণ করতাম। এর ফলে আমার পরিবার, বিশেষ করে আমার দুই ভাই, সমাজের কাছে খাটো হতো। তুচ্ছ্য-তাচ্ছিল্যের শিকার হতো। ফলে আমি স্বেচ্ছায় তাদের কলঙ্কমুক্ত করতে বাড়ি ছেড়ে চলে আসি।’
ঠিক কত বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন তা মনে করতে না পারলেও তিনি বলেন, ‘আমি যখন বাড়ি থেকে চলে আসি তখন আমি অনেক ছোট। তবে আজ থেকে প্রায় ৭-৮ বছর আগেতো হবেই।’
পিতা-মাতা, ভাই-বোন, বাড়ি-ঘর ছেড়ে যখন অজানার উদ্দেশে রাস্তায় বের হন ফুল, তখনও তিনি জানেন না পৃথিবীটা আসলে কতটা নিষ্ঠুর! আরো কী কী বঞ্চনা অপেক্ষা করছে তার জন্য।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর পথে ফুল হিজড়াদের একটি দলের দেখা পায়। তারা তাকে পেয়ে খুবই খুশী হয় এবং ফুলকে সাথে করে নিয়ে যায়। ফুল ভেবেছিলেন এবার হয়তো অন্যদের সাথে একটু শান্তিতে থাকতে পারবে। কিন্তু আশায় গুড়েবালি। তারা যে কোথাও থাকার জন্য ঘরও ভাড়া পায় না, কাজ করতে গেলে কাজ পায় না। ফলে বাধ্য হয়েই মানুষের কাছে হাত পাততে হয়।
‘যেখানেই ঘর ভাড়া নিতে যেতাম, সবাই তাড়িয়ে দিতো। বলতো এরা খারাপ। এদের জায়গা দেয়া যাবে না। কেউ কেউ ভাড়া দিলেও, টাকা বেশী নিতো,’ বিমর্ষমুখে কথাগুলো বলছিলেন ফুল।
কিন্তু আজ ফুলকে আর মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। খাবারের চিন্তা করতে হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ঘর পেয়েছেন ফুল। জীবিকা নির্বাহের জন্য পেয়েছেন সেলাই মেশিন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে মুজিববর্ষে সমাজে অবহেলার শিকার হিজড়া জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই আওতায় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় হাটিকুমরুল এলাকায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ‘প্রিয় নীড় আশ্রয়ণ প্রকল্প’র মাধ্যমে ফুলের মতো আরো ২০টি পরিবারের মোট ৫০ জন হিজড়াকে পুনর্বাসন করা হয়।
গত ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে মোট ৬৯ হাজার ৯০৪টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারের মাঝে ঘর হস্তান্তর করেন। এর মধ্যে ৬৬ শতাংশ জায়গার উপর গড়ে তোলা ৪টি পাঁচ ইউনিটের আধা-পাকা ব্যারাক ২০টি হিজড়া পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ঘর পেয়ে খুশিতে আত্মহারা ফুল জানান, এখন তাকে আর থাকা-খাওয়ার জন্য কারো কাছে হাত পাততে হবে না। বরং সমাজের আরো দশজনের মতোই মর্যাদার সাথে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
ফুল বলেন,‘বাড়ি ছেড়ে আসার আগ পর্যন্ত আমি বন্দী জীবন যাপন করছিলাম। কোনো অনুষ্ঠানে বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া ছিলো মানা। এমনকি অসুস্থ্য হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়াটাও ছিলো বারণ। কিন্তু আজ আমি স্বাধীন। আজ আমার থাকার ঘর আছে। দু-মুঠো ভাত জোগাড়ের ব্যবস্থা আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দু:খ অনুধাবন করেছেন। আমাদের জন্য সম্মানের সাথে জীবন যাপনের ব্যবস্থা করেছেন।’
এই ঘর ফুল এবং তার সহযোদ্ধাদের কাছে শুধু ঘরই না, বরং এটি সম্মানের প্রতীক। সামাজিক মর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সম্বল।
‘প্রিয় নীড় আশ্রয়ণ প্রকল্পে’র আরেক অধিবাসী ১৮ বছর বয়সী পরী মনি ছয় বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন একই কারণে। ফর্সা চেহারা আর সুন্দর মৌখিক গঠনের অধিকারী পরী মনি’র শখ ছিলো নায়িকা হওয়ার। মডেল হওয়ার। কিন্তু সে কি আর সম্ভব! সে জন্ম গ্রহণ করেছে ছেলে সন্তান হিসেবে।
‘আমি ছোট বেলা থেকেই মেয়েদের সাথে চলা-ফেরা করতে পছন্দ করতাম। সাজু-গুজো করতাম। এ জন্য আমার পরিবারের সদস্যরা আমাকে মারতো। ছেলেদের মতো আচরণ করতে বলতো। আসলে ছেলে-মেয়ের পার্থক্যই আমি তখন বুঝতাম না,’ বলছিলেন পরী মনি।
পরিবারের এসব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এবং পরিবারের সদস্যদের সামাজিক হেনস্তার হাত থেকে রক্ষা করতে, পরী মনি ঘর ছাড়ার আগে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন কয়েকবার।
‘বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার আগে প্রায়ই ভাবতাম আত্মহত্যা করে ফেলি। আমি মরে গেলেইতো মুক্তি পেয়ে যাবে তারা,’ বলছিলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঘর পেয়ে পরী মনি এখন ভীষণ খুশী। অতীতের সব দু:খ-কষ্ট ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। সমাজের অন্যান্য মানুষের মতোই সম্মানের সাথে বাঁচার স্বপ্ন তারও।
পরী মনি বলেন,‘এই ঘর আমার কাছে শুধু ঘর না। এটা একটা স্বপ্ন। প্রধানমন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমাদেরকে নিয়ে ভাববার জন্য। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়ার জন্য। আমরা তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ।’
ফুল আর পরী মনির মতই দেশে অনেক হিজড়া শিশু, কিশোর হওয়ার আগেই পরিবার থেকে, সমাজ থেকে হারিয়ে যায়। বঞ্চিত হয় তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে, শিক্ষা থেকে। বর্তমান সরকার তাদের কথা বিবেচনা করেই ২০১৩ সালে তাদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ২০১৯ সালে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার দেয়।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন বাসস’কে জানান, সরকার অর্ন্তভুক্তিমূলক উন্নয়নের অংশ হিসেবে সারা দেশের হিজড়া সম্প্রদায়ের সকল মানুষকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ‘প্রিয় নীড় আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২০টি পরিবারে মোট ৫০জন হিজড়াকে পুনর্বাসন করা হয়। তাদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ও কবুতর পালনের জন্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছে। তাদের আয়বর্ধক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে দিনাজপুর জেলার বাঙ্গিবেচা ব্রিজ সংলগ্ন হিজড়া পল্লিতে আরো ১২৫ জন হিজড়াকে পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও প্রকল্প পরিচালক জানান।

আপনি কি মনে করেন?

0 টি পয়েন্ট
উপনোট ডাউনভোট

একটি মন্তব্য

আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল আউয়াল সরকারের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক

দেশে করোনা টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন ৫২ লাখ ৫১ হাজার ৯৩৫ জন