ভিতরে

নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে অনলাইন বিজনেস

“২০২০ সালে যখন মাস্টার্স পরীক্ষার প্রস্ততি নিচ্ছিলাম তখনই বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়। করোনার প্রথম ধাপেই মাস্টার্স পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। একটি স্কুলে মাল্টি মিডিয়া সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। তাও বন্ধ। বন্ধ টিউশনিও। কিন্তু সংসারের চাকাতো সচল রাখতেই হবে। তখনই  ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে কিছু একটা করার পরিকল্পনা মাথায় আসে”, এভাবেই শুরু হয়েছিলো ঝালকাঠির কামরুন্নাহার মিলার পথচলা। 
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে অনলাইন বিজনেসে নিজের নাম যুক্ত করেন মিলা। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। 
বাসস’র সাথে আলাপকালে কামরুন্নাহার মিলা বলেন, ২০২০ সালের জুন মাসের শেষ দিন। আমার  ফেসবুক আইডি থেকে রুটি পিঠা এবং হাসের মাংস সাপ্লাইয়ের একটা পোস্ট দেই। পোস্টে লেখা ছিল, ম্যাসেঞ্জারে বা মোবাইল ফোনে অর্ডার দিতে হবে । গ্রাহকের বাসা বা অফিসে খাবার পৌছে দেয়া হবে। ফেসবুকে পোস্ট দেখে বরিশালের একজন ব্যাক্তি ২০০ পিস রুটি পিঠা এবং এক কেজি জদ্দার অর্ডার দেন। অর্ডার পাওয়ার পর মাথায় আসে আমি যে অর্ডার নিলাম আমারতো কিছুই রেডি নেই । তড়িঘড়ি করে মা, বড়বোন এবং দুলা ভাইয়ের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করি । তাদের সহযোগিতায় ০১ জুলাই বরিশালের ব্যবসায়ীর অর্ডার পৌছে দেই। চালের তৈরি রুটি পিঠা এবং জর্দ্দা খেয়ে ওই ব্যবসায়ী খুব প্রশংসা করেন । সেই থেকে শুরু ।
তিনি জানান, গত এক বছরে ডিজিটাল মাধ্যমে অর্ডার পেয়ে হাজারো মানুষকে নিজের হাতে তৈরি করা ৪০ আইটেমের খাবার সরবরাহ করছেন। প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টাকার অর্ডার সরবরাহ করেন । সব খরচ বাদ দিয়ে ৩০ শতাংশের মতো লাভ থাকে।  
ঝালকাঠি জেলা শহরের কামারপট্রি এলাকার বাসিন্দা মিলা দুই বোনের মধ্যে ছোট । মিলা বরিশাল বিএম কলেজে এমএসসি অধ্যায়নরত । বাবা পুলিশ কনেস্টবল শাহাদাৎ হোসেন ২০১৯ সালে মারা যান। বাবা মারা যাওয়ায় সংসার পরিচালনা নিয়ে চিন্তায় পড়েন মা জাহানারা বেগম। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পরই বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। সংসারে সহায়তা করার পথ খুঁজতে থাকেন মিলা। ২০২০ সালের প্রথম দিকে ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া সহকারী হিসেবে চুক্তিভিত্তিক চাকুরি পান । কিন্তু সারা বিশ্বে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়লে স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যায় । বেকার হয়ে পড়েন মিলা । ঐ বছরের মাস্টার্স পরীক্ষাও মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায়।
এক বছর আগের এইদিনে নিজের ফেসবুক আইডিতে (https://www.facebook.com/meg.mila.5)  
যখন চালের রুটি আর হাঁসের মাংস সরবরাহের পোস্ট দেন তখন মিলা ভাবতেও পারেন নি যে এতো দ্রুত সাড়া মিলবে। কিন্তু ভাগ্য তার দিকে চোখ মেলে তাকিয়েছে। প্রথম সাড়া ফেসবুক পোস্টের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পেয়েছিলেন। তারপর সময়ের সাথে সাথে একদিকে যেমন তার পরিচিতি বেড়েছে। বেড়েছে গ্রাহকও। মিলা সহযোগী রেখেছেন। 
তিনি প্রতিদিন ম্যাসেঞ্জারে এবং মোবাইল ফোনে বিভিন্ন খাবারের অর্ডার পান । মা এবং বড় বোন সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন। এছাড়াও  উচ্চ মাধ্যমিকের এক শিক্ষার্থী  মেয়েকে সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। মিলা এখন ৪০ ধরনের খাবার তৈরি করেন। তার তৈরি খাবারে মধ্যে রয়েছে, চালের রুটি , চালের ছিটরুটি, হাসের মাংস, জর্দ্দা, পুডিং, রসগজা পিঠা, সাজের পিঠা, পুলিপিঠা, শাহী টুকরা, চুইপিঠা, সেমাই পিঠা, ফিরনী, সুজির রসবড়া, পাটিসাপটা, মায়োনিজ, ফ্রোজেন পরাটা, নারকেলি নান, প্লেন পোলাউ, রোস্ট, গরুর রেজালা, গরু ভুনা, মুরগীর রেজালা, চিকেন বিরিয়ানি, চিকেন ফ্রাই, তেহারী, ভুনা খিচুরী, বিফ টিক্কা, বিফ কাবাব, চিকেন টিক্কা, চিকেন কাবাব, চিকেন তান্দুরি, নান রুটি, ভেজিটেবল রোল, চিকেন রোল, ডাল পুরি, চিকেন স্যান্ডউইচ, চিকেন পুলি, প্যানকেক, বিস্কি, নারকেল চিংড়ির ঝোল ইত্যাদি। শুধু ঝালকাঠি নয় বরিশাল এবং ঢাকার লোকজনও মিলার কাছে চালের রুটির অর্ডার দেন। এখন পর্যন্ত মিলা একদিনে সর্বোচ্চ এক হাজার রুটি এবং ২০০ লোকের বিরিয়ানীর অর্ডার সরবরাহ করেছেন । 
বরিশালের আলেকান্দার বাসিন্দা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর মো. শহীদুল্লাহ মিলার কাছ থেকে মাঝে মধ্যেই নানা ধরনের খাবার কেনেন। তিনি বলেন, আমাদের নজরুল পাঠাগারের একাধিক অনুষ্ঠানে ঝালকাঠির মিলার কাছ থেকে চালের রুটি পিঠা এনে খেয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে সেই গ্রামের দাদি-নানী বা ফুপুদের হাতে তৈরি পিঠা খাচ্ছি । শহুরে জীবনে আমরা সবাই এতো ব্যস্ত যে এখন আর গ্রামে যাওয়া হয় না । তাই ম্যাসেঞ্জারে অর্ডার দিয়ে রুটি পিঠা খেতে হচ্ছে ।
ঝালকাঠির ব্যবসায়ী এবং সমাজ সেবক আলহাজ্ব মনিরুল ইসলাম বলেন, নারী পুরুষ সবাই নানা কাজে ব্যস্ত তাই সময় করে পিঠা বা হাঁসের মাংস তৈরি করা হয়না। ঘরে তৈরি করতে অনেক সময় লাগে এবং কষ্টসাধ্য বিষয়। তাই আমিও প্রায়ই ম্যাসেঞ্জারে বা ফোনে মিলার কাছ থেকে রুটি পিঠা, রসগজা পিঠা, হাসের মাংস, গরুর মাংস ভুনা অর্ডার দিয়ে থাকি। তার রান্নাও চমৎকার। 
ঝালকাঠির সামাজিক সংগঠন ৭১ এর চেতনার সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দা মাহফুজা মিষ্টি বলেন, মিলা আপুর হাতে তৈরি খাবার খুবই টেস্টি , বিশেষ করে ভ’না খিচুড়ি অতুলনীয় ।
মিলা জানান, ডিজিটাল মাধ্যমে অর্ডার  পেয়ে ৪০ ধরনের খাবার সরবারহের পাশাপশি অনলাইনে কিছু লেডিস পোষাকও বিক্রি করছেন। খাবার এবং পোষাাক বিক্রির টাকায় নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েও পরিবারে সহায়তা করতে পারছেন । সহযোগী মেয়েটির পড়াশোনার খরচও তিনিই বহন করছেন। 
ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে মিলা বলেন, স্বনির্ভর হয়ে মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই আমার স্বপ্ন । আমার বাবারও মৃত্যুর আগে এমনই ইচ্ছা ছিল । তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে সবার জন্য ইন্টারনেট সহজলভ্য করার কারণেই আজ আমরা অনলাইনে ব্যবসা করতে পারছি । সারা দেশ বিদ্যুতায়ন এবং মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আসায় আমি মেয়ে হয়েও যে কোন জায়গায় খাবার পৌছানোর সাহস দেখাচ্ছি ।

আপনি কি মনে করেন?

0 টি পয়েন্ট
উপনোট ডাউনভোট

একটি মন্তব্য

ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই : তথ্য ও সম্প্রচার সচিব

তিনদিনে বাড়তে পারে পার্বত্য এলাকার প্রধান নদ ও নদীর পানি সমতল