ভিতরে

‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ মহেশখালী : বদলে যাওয়া এক দ্বীপের গল্প

॥ আবু তাহের ॥
কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী’র আদিনাথ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী শিখা পাল এখন ঢাকার অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ নেয়। দুর শিক্ষণের মাধ্যমে সে নিজ বিদ্যালয়ে বসে বাংলা, ইংরেজী, অংক, বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠ নিচ্ছে। জাগো ফাউন্ডেশনের ডিজিটাল স্কুলের শিক্ষক ফারিহা আহমদ ঢাকায় বসেই সরাসরি মহেশখালী দ্বীপের শিক্ষার্থী শিখাদের ইংরেজী পড়াচ্ছেন। শিখার মতো বুলবুল, তাসনিয়া, জুয়েলসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও খুশী ইন্টারনেট সুবিধা নিয়ে দুর-শিক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে শিখতে পেরে। 
ছোট বড় তিনটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত মহেশখালী। একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে এই উপজেলা অনেকটা দুর্গম এলাকা। দ্বীপের উত্তর প্রান্তের কালারমারছড়া ইউনিয়ন থেকে উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন আনোয়ারা বেগম। তার বাচ্চাটি চর্ম রোগে আক্রান্ত। কিন্তু হাসপাতালে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোন চিকিৎসক নেই। হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার শিব শেখর ভট্টাচার্য্য ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। আনোয়ারা বেগমের মেয়ের চর্ম রোগের ব্যবস্থাপত্র দিলেন। আনোয়ারা বেগমের মত দ্বীপের আরো অনেককে জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য আর দূরে যেতে হচ্ছে না। দ্বীপে বসেই ডিজিটাল মাধ্যমের সুযোগ নিয়ে ঢাকার বা অন্য কোন শহরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে পারছেন। 
মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে শুধু পড়ালেখা বা চিকিৎসা সুবিধা নয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে অনেকেই এখন যুক্ত হয়েছেন ব্যবসায়। নিজেদের গড়ে তুলছেন উদীয়মান ‘উদ্যোক্তা’ হিসেবে। তাদেরই একজন মারুফা আকতার। তারা ৯ বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছেন অনলাইনে বিষমুক্ত শুটকি বিক্রির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ই-বিজনেস সেন্টার’। এই তরুণ উদ্যোক্তারা বিষমুক্ত শুটকি মাছ উৎপাদন করে অনলাইনে দেশের নানাপ্রান্তে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছে দেশের অন্যতম বৃহৎ অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো। মহেশখালীতে বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও তাদের কাছ থেকে শুঁটকি কেনেন।  
এভাবেই বদলে যাচ্ছে প্রত্যন্ত দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী। মহেশখালী এখন আর দুর্গম দ্বীপ নয়, এখন এর পরিচয় বদলে হয়েছে “ডিজিটাল আইল্যান্ড”। তা সম্ভব হয়েছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও দেশব্যাপি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন। ইতিমধ্যেই মহেশখালীকে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ ঘোষণা করা হয়েছে। ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী’র বিভিন্ন ই- সেবা কেন্দ্র, ই-কমার্স সেন্টার এবং ডিজিটাল স্কুল সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। বর্তমান সরকার তথ্য প্রযুক্তির সেবা গ্রামের তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে যে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করেছে, মহেশখালী দ্বীপ এই সেবার আওতায়। মহেশখালীর বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা স্থানীয় জনগোষ্ঠীটিকে উন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের পরিষেবা গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। 
২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহেশখালীকে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এর সাথে যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও কোরিয়া টেলিকম।  
ইন্টারনেটের আওতায় ৫০ হাজার মানুষ: দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর ঘরে ঘরে এখন উচ্চগতির উন্টারনেট। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও কৃষিসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা আসছে অপটিক্যাল ফাইবারে ভর করে। আর তা সম্ভব হয়েছে সরকারের ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্পের কারণে। দ্বীপের ৫০ হাজার মানুষ এখন ইন্টারনেটের আওতায়। মহেশখালীতে বেড়াতে আসা পর্যটকরাও এই সুবিধা নিতে পারছেন। দ্বীপের ৩ লাখ মানুষের জীবন মান উন্নয়ন ও আধুনিক দ্বীপ গড়ার লক্ষ্যে ২২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্বীপে দ্রুতগতির এই ইন্টারনেট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সরকারের এই ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্প বাস্তবায়নে আইওএম অর্থ সহায়তা দিয়েছে। 
আইওএম-এর ডেপুটি চীফ মিশন ম্যানুয়েল মারকুইজ পেরেইরা বলেন, মহেশখালী দ্বীপটি বাংলাদেশের স্বল্প-উন্নত জনগোষ্ঠীর একটি এলাকা। এখানে নিরক্ষরতার হার বেশি। মাটির লবণাক্ততা কৃষি ফলনকে বাধাগ্রস্থ করে। স্থানীয় যুবসমাজ জীবিকার তাগিদে দ্বীপ থেকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ডিজিটাল দ্বীপ প্রকল্পটির লক্ষ্য হল সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বিদ্যমান জনসুবিধার আরো প্রসার ঘটিয়ে মহেশখালীর বাসিন্দাদের জন্য সুযোগ তৈরি করা। তিনি জানান, প্রকল্পটির কারণে মহেশখালীর বাসিন্দারা ১৫০ এমবিপিএস গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছেন। 
মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহফুজুর রহমান বলেন, ডিজিটাল আইল্যান্ড একটি বহুমুখী প্রকল্প যা বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীটিকে দ্রুততম গতির ইন্টারনেট সেবার মাধ্যমে বিশ্বের সাথে যুক্ত করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মহেশখালীর আমুল পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, টেলিমেডিসিন, দুর-শিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তি ও কমিউনিটি ক্লাবের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন জনগণ। দ্রুতগতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসন ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে ৮০ শতাংশ দাপ্তরিক কাজ করছে। 
মাহফুজুর রহমান বলেন, “সব সরকারি অফিস এবং বেশ কিছু স্কুলে ইন্টারনেট ও মাল্টিমিডিয়া সুবিধা দেয়া হয়েছে। যে কারণে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই দ্বীপ এখন অনেক এগিয়ে। প্রকল্পের মাধ্যমে কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এখানে সারাবছরই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে।”
তিনি জানান,কীটনাশক এবং সংরক্ষণকারী রাসায়নিক উপকরণের ব্যবহার কমিয়ে স্থানীয়দের জৈব কৃষি এবং অর্গানিক পদ্ধতিতে মাছ শুকাতে উৎসাহিত করছে এই প্রকল্প। পাশপাশি ই-কমার্সের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে আয় বাড়ানো ও মধ্যস্বত্তভোগীদের দৌরাত্ম দূর করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। 
শিক্ষার্থীদের জন্য দূর-শিক্ষণ পরিষেবা: জাগো ফাউন্ডেশন মহেশখালীর দশটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দূর-শিক্ষণ পরিষেবা দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় রাজধানী ঢাকার শিক্ষকরা মহেশখালী দ্বীপের শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষা দেন। আদিনাথ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনিয়া জানায়- ‘ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আমরা ঢাকার ম্যাডামের কাছ থেকে পড়া শিখছি। এতে আনন্দ পাচ্ছি, নতুন নতুন অনেক কিছু শিখতে পারছি।’
জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক করভী রাকসান্দ বলেন, মহেশখালী দুর্গম হওয়ায় ঢাকা থেকে ভালো শিক্ষক নিয়ে সেখানে দীর্ঘসময় রাখা যায় না। আমরা প্রথমে সেখানে গিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি। পরে ঢাকা থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে দ্বীপের ১০টি স্কুলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা শুরু করি। এর মাধ্যমে ইতিমধ্যে ৯ হাজার শিশু অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছে।
স্বাস্থ্যসেবায় টেলিমেডিসিন: মহেশখালীর চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং একটি উপজেলা হাসপাতালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যাচ্ছে। এসব সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় স্বাস্থ্যগত রেকর্ড সিস্টেম, টেলিমেডিসিন পরামর্শ, মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে রোগ নির্ণয়। এই কাজে সরকারী কর্মকর্তাদের কম্পিউটার দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে আইওএম এর ডিজিটাল সেন্টারে। 
ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পের পরিচালক জাহিদ এম ফিরোজ বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা হেলথ ইউনিটগুলোতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছি। যার মাধ্যমে মানুষ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারছে। তিনি বলেন, আগে মহেশখালীতে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের জন্য ২৫ মিটারের একটি টাওয়ার ছিল। যার ক্ষমতা ছিল সামান্য। এখন এখানে ৫০ মিটার উচ্চতার নতুন টাওয়ার বসানো হয়েছে। এতে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছেন দ্বীপবাসি।
মহেশখালী পৌরসভার মেয়র মকছুদ মিয়া বলেন ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পের মাধ্যমে মহেশখালীবাসি অনেক সুফল পাচ্ছেন। জনগণ আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষা পাচ্ছে। কৃষকরাও সুফল পাচ্ছেন। নতুন নতুন ব্যবসা শুরু হচ্ছে। সব ইউনিয়নে একসাথে কাজ শুরু করা গেলে এর সফলতা আরো বৃদ্ধি পাবে।

আপনি কি মনে করেন?

0 টি পয়েন্ট
উপনোট ডাউনভোট

একটি মন্তব্য

শাপলা চত্বরে ৫ মের তাণ্ডব: বিএনপি নেতা আসলাম রিমান্ডে

সারা দেশে ১ থেকে ৭ জুলাই সেনা মোতায়েন থাকবে : আইএসপিআর