ভিতরে

তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন যুব সমাজের সামনে কর্মসংস্থানের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে

॥ সঞ্জিব চন্দ বিল্টু ॥
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা মানেই গোঁড়ামি আর অনগ্রসরতা। হয় মসজিদের ইমামতি, নয়তো ছা-পোষা ধর্মীয় শিক্ষক। মাদ্রাসা পড়ুয়াদের নিয়ে এমন চিত্রই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সভ্যতা আর প্রযুক্তিকে সহজে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় কুসংস্কার সবকালেই বড় বাঁধার নামান্তর। কিন্তু চিরাচরিত সেই ধ্যান-ধারণাকে উপেক্ষা করে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় নতুন বোধের সৃষ্টি করেছেন কওমী মাদ্রাসা ছাত্র মিনহাজ উদ্দিন। যার পরিশ্রম, ইচ্ছা আর দৃঢ় প্রত্যয়ের কাছে হার মেনেছে সব প্রতিবন্ধকতা। ধর্মীয় পিছুটানের বেড়াজাল ছিন্ন করে সব বাধাকে জয় করে মিনহাজ উদ্দিন আজ একজন সফল আইসিটি উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দশটি বিশেষ উদ্যোগ কর্মসূচির অন্যতম ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর সফল বাস্তবায়নের ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট সংযোগ। তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিভাগের বহুমুখী দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং দেশব্যাপি ইন্টারনেট সংযোগ মিনহাজের মতো হাজার হাজার যুবকের সামনে কর্মসংস্থানের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।  মিনহাজের সাফল্য আজ এটাই প্রমাণ করেছে যে পড়ালেখা শেষ করে একটি গতানুগতিক চাকুরীর চেষ্টা, কিংবা বেকারত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে পরিবার ও সমাজের কাছে মাথা নত করে থাকার দিন ফুরিয়েছে।
কওমী মাদ্রাসার ছাত্র মিনহাজ উদ্দিন নিজ অধ্যবসায়ে যেমন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ভাগ্য পাল্টেছেন, তেমনি তাকে দেখে মাদ্রাসা ছাত্র থেকে শুরু করে অন্যান্য তরুণরাও ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিংয়ে ঝুঁকছেন। যারা আগ্রহ নিয়ে আসেন, মিনহাজ তাদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। হতাশাগ্রস্ত যুবকদের স্বাবলম্বী হতে অনুপ্রেরণা যোগান তিনি। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের আইসিটি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ।
জামালপুরের সন্তান মিনহাজ কিশোর বয়সে মামার হাত ধরে শেরপুর আসেন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতে। ভর্তি হন শেরপুর শহরের তেরাবাজার জামিয়া সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসায়। সেখান থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে স্বপ্নবাজ মিনহাজ স্নাতকে ভর্তি হন শেরপুর সরকারি কলেজে। এখানেই শুরু হয় তার স্বপ্ন পূরণের বীজ বোনা।
কলেজে পড়াশুনার পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশন করে পড়ালেখা শেষ করেন মিনহাজ। মা-বোবা, ছোট বোনকে নিয়ে সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। একটা চাকরির জন্য খুব চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হয়নি। ২০১৭ সালে এলআইসিটি নামে একটা প্রকল্প শুরু হয় শেরপুর সরকারি কলেজে। সেখানে বিনামূল্যে সফটওয়ার স্কিল ও ওয়েব ডিজাইন কোর্স করেন মিনহাজ। কম্পিউটারের কিছু প্রাথমিক ধারণা ছিল আগে থেকেই। ওই প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যে তেরাবাজার মাদ্রাসায় পড়েলেখা করেছেন, সেই মাদ্রাসাতেই এখন তিনি শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তরুণদের বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য আইসিটিতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছেন। আজ তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা ও ফ্রি-ল্যান্সার। শুধু তিনি নন, তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই আজ স্বাবলম্বী। তার প্রতিষ্ঠানে এখন ৮ জন নিয়মিত আউটসোর্সিং এর কাজ করছেন। যাদের প্রত্যেকের মাসিক আয় প্রায় ১৫০০ মার্কিন ডলার। আরও ৮ জন রয়েছেন যারা নিয়মিত মাসিক আয় করছেন ২০০ ডলার থেকে ৩০০ ডলার করে। অন্তত: ১২০ জনকে তিনি বিনামূল্যে আইসিটিতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এছাড়া সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার ও আইসিটি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রকল্প নামে একটি উদ্ভাবনী প্রকল্পের আওতায় মাসব্যাপী  প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছেন। এরই মধ্যে প্রথম ব্যাচের ২০ জন মাদ্রাসা ছাত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।
মিনহাজ উদ্দিন বাসসকে বলেন, কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা কি শুধু মসজিদ-মাদরাসায় চাকরি করবে? এর বাইরে কি তাদের কোন সুযোগ নেই? মফস্বল থেকে কী কিছু করা সম্ভব? এমন চিন্তায় ভিন্ন কিছু করার ভাবনা মনে শেকড় গাড়ে।   কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি ভালো কিছু করতে পারে, তাহলে কওমির ছাত্ররা কেন পারবে না? এমন ভাবনা থেকেই কম্পিউটার ও আইসিটিতে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, সরকারি কলেজে সঠিকভাবে কোর্স শেষ করার আগেই ইন্টারনেট ঘাটঘাটি করতে গিয়ে একটি সেবা সংস্থায় কাজ পেয়ে যাই। প্রথম কাজ করেই পেলাম ২০ হাজার টাকা। স্বপ্ন বড় হতে থাকলো। চাকরির পাশাপাশি নিজের ইচ্ছায় ইউটিউব ও গুগল থেকে ওয়েব ডিজাইন শেষ করি। তারপর ঢাকার উত্তরার সফটটেক আইটি থেকে অনলাইন কোর্সে ভতি হয়ে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কোর্স শেষ করি। বর্তমানে বাংলাদেশে বসে অস্ট্রোলিয়ার একটা সেবা সংস্থায় আইটি স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করছি। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ারের সাথে কাজ করছি। পাশাপাশি নিয়মিত ফ্রিল্যান্সিং করছি।
মাসে কেমন আয় করছেন, এমন প্রশ্নে নিজের উপার্জনের বিষয়টি মুচকী হেসে এড়িয়ে যান। কিন্তু লম্বা দাঁড়ি, মাথায় টুপি গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবী পড়া মিনহাজ উদ্দিনের সেই ঠাঁটের কোনের হাসিতে বিলক্ষন বোঝা যায়, আয়-উপার্জন বেশ ভালো। অনলাইন মার্কেটপ্লেস লোকাল মার্কেট থেকে ভালো টাকা উপার্জন করছেন। মিনহাজ জানালেন, এখন পরিবার বাবা-মা, ভাই-বোনকে সহযোগিতা করতে পারছেন। পরিশ্রম করে পাওয়া সাফল্যের আনন্দ এখন তাঁর চোখেমুখে। মিনহাজ বলেন, “ফ্রিল্যান্সিং আমার জীবনে একটা বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে।” তিনি মনে করেন, মফস্বলে থেকেও ছাত্ররা ইচ্ছা করলেই ফ্রিল্যান্সিং এর মত একটা স্মার্ট পেশাকে বেছে নিতে পারেন। প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছা, ধৈর্য্য আর লেগে থাকার মানসিকতা।
তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং একটি স্মার্ট পেশা। চাকরির পিছনে না ঘুরে নির্দিষ্ট একটা বিষয়ের উপর দক্ষ হয়ে ফ্রিল্যান্সিং করলে মাসে ৪০/৫০ হাজার টাকা উপার্জন করা সম্ভব। তাই আমি মনে করি, পড়াশোনা বা চাকরির  পাশাপাশি যে কেউ এই পেশায় যুক্ত হতে পারেন। ধৈর্য্য ধরে কাজ করলে সফলতা আসবেই।
মিনহাজের কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ পেয়ে মাসে প্রায় দেড় হাজার মার্কিন ডলারের মতো আয় করছেন নালিতাবাড়ীর এমদাদুল হক এবং কলেজ ছাত্র শহরের গৌরিপুর এলাকার সুমন মিয়া। তারা বলেন, মিনহাজ ভাই খুব ভালো মানুষ। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও তিনি অগ্রসর চিন্তার মানুষ। তার কাছ থেকে উৎসাহ আর প্রশিক্ষণ পেয়ে আজ আমরা আমাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছি। এখনও যেকোনো প্রয়োজনে তিনি আমাদের সহযোগিতা করেন। তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
শেরপুর তেরাবাজার জামিয়া সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ মাওলানা শাহীনুল ইসলাম শাহীন বলেন, মিনহাজ খুব পরিশ্রমী এবং অগ্রসর চিন্তার মানুষ। মাদ্রাসায় লেখাপড়া-শিক্ষকতা করলেও সে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং চিন্তা-চেতনার সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সংযোগ ঘটিয়ে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে চেষ্টা করছেন। ধর্মীয় বিধিবিধান মেনেও কীভাবে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বৈধপন্থায় হালাল উপায়ে আয়-উপার্জন করা যায় তার মডেল হলেন মিনহাজ উদ্দিন। আমরা তার মঙ্গল কামনা করি।
শেরপুর কালেক্টরেটের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক এটিএম জিয়াউল ইসলাম বাসসকে বলেন, মিনহাজ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সবার ধারণা পাল্টে দিয়েছে। সে জেলার একজন শ্রেষ্ঠ ফ্রি-ল্যান্সার। নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কীভাবে আইসিটিতে দক্ষ করা যায়, সমাজের প্রচলিত ধারণা ভেঙ্গে ইতিবাচক মানসিকতা তৈরী করা যায়, মিনহাজ সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।

আপনি কি মনে করেন?

0 টি পয়েন্ট
উপনোট ডাউনভোট

একটি মন্তব্য

কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা : পলক

করোনায় চট্টগ্রামে ১০ রোগীর মৃত্যু