ভিতরে

ডিজিটাল টকিং বুকস : ‘পড়বে সবাই, শুনবে সবাই, বাদ যাবে না কেউ’

॥মো. জিগারুল ইসলাম ॥
চট্টগ্রামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী আসমাউল হোসনা। ২০২০ সালে কোভিডের কারণে যখন লকডাউন শুরু হয় তখন কল্পনাও করতে পারেনি যে সহসাই আর স্কুলে ফিরে যাওয়া হবে না। একারণে লকডাউনের সময়সীমা বাড়তে থাকায় অনেকটাই উদ্বিগ্œ হয়ে পড়েছিলো তার অভিভাবক ও সহাপাঠিরা। কিন্তুসেই অনিশ্চয়তা দূর করে দিয়েছে ডিজিটাল টকিং বুকস।
আসমাউল হোসনা বাসসের সাথে আলাপকালে জানান, আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে বাড়ি চলে আসি। তারপর জানতে পারি লকডাউন দেয়া হয়েছে। আমরা তো জানতাম না, লকডাউনের কারণে এতদিন স্কুল বন্ধ থাকবে। সেজন্য স্কুল থেকে ব্রেইল বই আনিনি। কিন্তু মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক থাকায় ব্রেইল বই ছাড়াও আমরা পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছি। বর্তমানে আমাদের পড়াশোনা অনেকটা ডিজিটাল বইয়ের ওপরই নির্ভরশীল। ডিজিটাল টকিং বুক একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে আমার জন্য যেমন উপকারি, তেমনি আমার পরিবারে যারা চোখে দেখতে পান তারাও এই বই দেখতে এবং পড়তে পারেন। 
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ-টু-আই প্রকল্পের অধীন সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডে চট্টগ্রামের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন)  প্রতিবন্ধীদের জন্য দেশে প্রথম ডিজিটাল টকিং বুকস তৈরি করে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার সব বই সব শিশু পড়বে, শুনবে, দেখবে। ব্যবহার করা যাবে কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ফোনে,। প্রিন্ট করা যাবে ব্রেইল কিংবা বড় হরফে। “পড়বে সবাই, শুনবে সবাই, বাদ যাবে না কেউ” এই ধারণা থেকে ইপসা’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ভাস্কর ভট্টাচার্য্য ‘মাল্টি মিডিয়া টকিং বুক’ উদ্ভাবন করেন। তিনি এটুআই-এর এই প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ পরামর্শক। 
এই মাল্টি মিডিয়া টকিং বুকস হচ্ছে ‘ঋঁষষ ঞবীঃ ঋঁষষ অঁফরড়’ ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া বই। যেটা দেখা যায়, শোনা যায়। দেশের হাজার হাজার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু এখন ‘ডিজিটাল টকিং বুকস’ ব্যবহার করে সহজ পদ্ধতিতে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। এই মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকের জন্য বাংলাদেশ সরকারের এ-টু-আই প্রোগ্রাম ২০১৭ সালে ‘ডব্লিউএসআইএস’ পুরস্কার অর্জন করে।
বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের বই পড়ার অসুবিধা অনেকটাই কমিয়ে এনেছে ‘ডিজিটাল টকিং বুকস’। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা একসময় ক্লাসে পড়ার জন্য ব্রেইল বই পেতো না। পেলেও সেটা ১০ বছর আগের পুরনো বই। যে বইয়ের সাথে সিলেবাসের কোন মিল ছিল না।  
চট্টগ্রাম মোহসেনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তানজিলা চৌধুরী। বড় দুই বোনের মতো তিনিও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। বড় দুই বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বোনদের স্কুলে যেতেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও বড় দুই বোনের পড়াশোনা করার বিষয়টি তার খুব ভালো লাগতো। বোনদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পরিবারের সদস্যদের অনুপ্রেরণায় তিনি পড়াশোনায় আগ্রহী হন। ভর্তি হয়ে অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো ফলাফল করতে শুরু করেন। কিন্তু তানজিলার পড়াশোনা করা মোটেও সহজ ছিল না। 
ছাত্র জীবনের স্মৃতিচারণ করে তানজিলা বলেন, বছরের শুরুতে আমার সহপাঠিরা নতুন বই পেয়ে যেতো। তারা পড়াশোনা শুরু করতো। কিন্তু সে বই আমার জন্য ছিল না। আমার জন্য বই পরেও আসতো না। নিজের পড়ার জন্য প্রচলিত পাঠ্যপুস্তক কাউকে দিয়ে পড়িয়ে শুনে শুনে নিজেই ব্রেইল পদ্ধতিতে বদলে নিতাম। কিংবা কাউকে দিয়ে পড়িয়ে তা রেকর্ড করে টেপ রেকর্ডারে বাজিয়ে শুনে শুনে পড়তে হতো। এভাবে পড়ালেখা করেছি আমি। কিন্তু এখন ‘ডিজিটাল টকিং বুকস’ এনেছে সরকার। খবরটা শোনার পর অনেক আনন্দ বোধ করেছি। মনে হচ্ছে, এতদিনে আমার মতো শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা সহজ হলো।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বই পড়া সহজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘ডিজিটাল টকিং বুকস’। মূলত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বই পড়ায় উৎসাহিত করার জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়। এই ডিজিটাল টকিং বুক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বই তৈরির খরচ অনেকটা কমিয়ে এনেছে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ-টু-আই কর্তৃক ইনোভেশন এ্যাওয়ার্ড দেয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষার ডিজিটাল বই তৈরি করার জন্য। আর এই এ্যাওয়ার্ডের অর্থ দিয়ে চট্টগ্রামের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন) এ কার্যক্রম সফলভাবে সম্পাদন করে। শুরুতে প্রথম  থেকে পঞ্চম শ্রেণীর ৩৩ টি, ক্রমান্বয়ে মাধ্যমিকের ষষ্ট থেকে দশম শ্রেণীর আরো ৭৪ টিসহ মোট ১০৭ টি বই ইউনিকোডে কনভার্ট করা হয়। প্রত্যেকটি বই জাতীয় ই-তথ্য কোষে আপলোড করা হয়। এই ইউনিকোড বইগুলো বাংলা স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যার দিয়ে পড়া যায়। এ জন্য বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে বাংলা এনভিডিএ স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যার। ইউনিকোডে রূপান্তরিত এসব বইা শুধু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু নয়, সব শিশুর শিক্ষাকে সহজ করতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। 
তানজিলা আরও বলেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এদের বেশিরভাগ উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকার কারণে পড়ালেখা করতে পারে না। এ বিপুল সংখ্যক দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর কথা মাথায় রেখে চট্টগ্রামের উন্নয়ন সংস্থা ‘ইপসা’ সরকারের এ-টু-আই প্রোগ্রামের সহায়তায় টিজিটাল টকিং বুকস তৈরি করেছে। এতে বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য মাইলফলক রচিত হয়েছে। ডিজিটাল টকিং বুকের কারণে এখন আমার মতো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষকদেরও শিক্ষার্থীদের পাঠদানে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এটি তার সফল প্রতিরূপ। 
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে সরকার গঠন করার পর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইপসা’র তৈরি মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকস উদ্বোধন করেন। তিনি এই মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের হাতে তুলে দেয়ার এবং ব্রেইল বই প্রদান করার নির্দেশনা দেন। সরকার ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর ব্রেইল বই ও মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকস বিনামূল্যে প্রদান করে আসছে। 
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০৭ টি ডিজিটাল টকিং বুক আমিস সফটওয়্যারের মাধ্যমে এখন শুনতে ও পড়তে পারছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। বাংলা আমিস একটি মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার। আমিস হল এডপটিভ মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম। এটি একটি সম্পূর্ণ ওপেন সোর্স সফটওয়্যার। িি.িধসরং.ংভ.হবঃ-এর বাংলা ষধহমঁধমব ঢ়ধপশ টি বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে। আমিস বাংলা লোকালাইজেশনের মধ্য দিয়ে বাংলাকে ডেইজি পূর্ণাঙ্গ পরিবারভুক্ত করে নিয়েছে। এখন থেকে বাংলা ডেইজি ব্যবহারকারীরা সম্পূর্ণ টেক্সট, সম্পূর্ণ অডিও বাংলা ডেইজি বই পড়তে ও শুনতে পারবেন। ওয়েব : িি.িফধরংু.ড়ৎম
এছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০৭ টি বইকে ডিজিটাল ব্রেইল বইয়ে পরিণত করা হয়েছে, যাতে খুব সহজে ব্রেইল প্রিন্ট করা যাবে। একটি ব্রেইল প্রিন্টার থাকলে সহজে ব্রেইল প্রিন্ট করা যাবে, ব্রেইল জানতেও হবে না। এতে করে  ব্রেইল করার খরচও কমে যাচ্ছে প্রায় ৭০ শতাংশ।
মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকস ডেইজি (ডিজিটাল একসেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেম)এর উদ্ভাবক ভাস্কর ভট্টাচার্য্য জানান, পৃথিবীর একটি অন্যতম জনপ্রিয় ব্রেইল সফটওয়্যার বিভিন্ন ভাষায় রূপান্তর করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলায় লোকালাইজেশনের ওপর কাজ শুরু হয়েছে। যা ইতোমধ্যে বাংলায় ব্রেইল কনভার্টার হিসেবে কাজ করছে। বাংলাকে ব্রেইলে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে প্রাাথমিক পর্যায়ে কিছু ভুলত্রুটি থাকলেও এখন তা নেই। আর আমরা এই বইগুলো ব্রেইলে রূপান্তর করেছি ডাস্কবেরি সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই ডাস্কবেরি সফটওয়্যার ব্যবহার করেন, যা আমাদের উৎসাহিত করেছে বাংলা লোকালাইজেশনের জন্য।
তিনি বলেন, ডেইজি টকিং বুকস তৈরির উদ্দেশ্য হলো সবার জন্য বই, সবার জন্য গ্রন্থাগার, সবার পড়ার অধিকার সংরক্ষণ। প্রত্যেকটি বই প্রকাশিত হবে একটি আন্তর্জাতিক মানদ-ে, যা সোর্স ফাইল থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে বই প্রকাশিত হবে। আর সেই বই কিংবা গ্রন্থাগার ব্যবহার করার সুযোগ পাবেন সবাই। দীর্ঘদিন ধরে সবার জন্য  ডেইজি নিয়ে কাজ করছি, কিছুটা সাফল্যও এসেছে। বাংলাদেশ সরকারের এক্সেস-টু-ইনফরমেশন (এ-টু-আই) প্রজেক্টে (িি.িরহভড়শড়ংয.মড়া.নফ) এই ডেইজি কনটেন্টগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। ডেইজি কম্পিউটারভিত্তিক বহুমাত্রিক (মাল্টিমিডিয়া) মাধ্যমের জন্য একটি উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক মানদ-। িি.িফধরংু.ড়ৎম সাইটে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রন্থাগার ডিজিটালাইজড হবে। ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে বই প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। গ্রন্থাগারের কার্যক্রম মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। আর এজন্য দরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেয়া উদ্যোগগুলোর সাথে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। আর ভাবতে ভালো লাগছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সব বই এখন ডেইজি বইয়ে পরিণত হয়েছে আর সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশু তা ব্যবহার করতে পারছে। 
চট্টগ্রামের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক মো. হাসান জানান, ডিজিটাল টকিং বুকস এখন এক্সেসেবল ই-বুক, মাল্টিমিডিয়া বুক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ডেইজি মাল্টিমিডিয়া বইয়ের মাধ্যমে এখন শিশুরা বই দেখতে, পড়তে ও শুনতে পারছে। এই বইয়ে টেক্সটের সাথে অডিও সংযুক্ত করা হয়েছে। এটি অভিনব। গ্রামের নিরক্ষর কৃষক যেমন তার শিশুকে এই ডিজিটাল বই শুনে শুনে পড়াতে পারবেন, তেমনি একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অভিভাবক তার সন্তানকেও পড়াতে পারবেন এই ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া অডিও বইয়ের মাধ্যমে। 
তিনি বলেন, প্রাথমিকের ৩৩ টি বইকে ডেইজি স্ট্যান্ডার্ডে রূপান্তর করার কারণে আমি একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক হয়েও মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রূমের মাধ্যমে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিকভাবে ক্লাস করাতে পারছি। 
ইপসা’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ভাস্কর ভট্ট্যাচার্য বলেন, আসলে আমি নিজেও একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ। আমি কখনো বই পেতাম না। সিলেবাসের সাথে মিল নেই ১০ বছর আগের এমন পুরনো ব্রেইল বই দিয়ে পড়ালেখা করতে  হয়েছে আমাকেও। যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলেন, তখন থেকেই আমরা চেষ্টা করছিলাম যাতে বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ অন্যান্য শিশুদের মত বই পায়। বছরের শুরুতেই যখন লক্ষ লক্ষ শিশুর হাতে নতুন বই তুলে দিতেন প্রধানমন্ত্রী তখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা বই না পাওয়ায় মনোকষ্টে থাকতাম। 
তিনি বলেন, আমার মেয়ে যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে তখন সবসময় তার বইটা এনে আমাকে বলতো বাবা বইটা একটু পড়ে দাও। আসলে আমি পড়ে দিতে পারতাম না। কারণ প্রিন্টেড বই আমি কি করে পড়ব ? আমি বলতাম তোমার মা’র কাছে যাও। কিন্তু সে  মায়ের কাছে না গিয়ে আমাকেই বারবার বলতো এবং আমার চোখের সামনে বই দিয়ে বলতো ‘পড়ে দাও, পড়ে দাও’। তখন আমি ভাবলাম, আমি কি এমন একটা বই উদ্ভাবন করতে পারি, যে বইটা আমি শুনতে পারব, আর আমার মেয়ে পড়তে পারবে, দেখতে পারবে। তখনই মূলত আমার এই আইডিয়াটা মাথায় আসে। এরপর মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকের আইডিয়াটা ইপসা থেকে এ-টু-আই’তে জমা দেয়া হয়।  সেটা হচ্ছে প্রথম থেকে দশম শ্রেণীর সকল বইকে মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক করা। এটাতে সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড উইন করি আমরা। এরপর প্রথম থেকে দশম শ্রেণীর ১০৭ টি মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক আমরা তৈরি করি। 
তিনি জানান, মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক যাতে সহজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ ব্যবহার করতে পারে সেজন্য আমরা এক্সেসেবল বুক রিডার তৈরি করি। এটা একটা এন্ড্রয়েড ফোনের মত ডিভাইস। এন্ড্রয়েড ফোনের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। প্রায় দুই হাজারের বেশি এই এন্ড্রয়েড এক্সেসেবল বুক রিডার এ-টু-আই থেকে আমরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। 
এছাড়াও ইপসা থেকে প্রায় দু’হাজারের মতো স্মার্টফোন সারা বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের দেয়া হয়। মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক এ সমস্ত ডিভাইসের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা ব্যবহার করা শুরু করে। সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়গুলোতে ছয়টি ই-লার্নিং ল্যাব রয়েছে, সেখানেও মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক ব্যবহৃত হচ্ছে। 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাস্কর ভট্টাচার্য্যর উদ্ভাবিত মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকের জন্য বাংলাদেশ সরকারের এ-টু-আই প্রোগ্রাম ২০১৭ সালে ‘ডব্লিউএসআইএস’ পুরস্কার অর্জন করে। তিনি উদ্ভাবক হিসেবে ইউনেস্কো পুরস্কার এবং হেনরি ভাস্কার দ্যা এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। ২০১৬ সালে সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পুরস্কৃত করেন। মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকস বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। 
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী দৃষ্টিশক্তি হারানো চট্টগ্রামের মো. সাফিউল আলম রাফি বলেন, স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি নিয়ে জন্মালেও আমি একপর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি। অনেক চিকিৎসা করেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাইনি। আমি ব্রেইলও জানতাম না। মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক ছিল আমার জন্য একমাত্র অবলম্বন। এটি ব্যবহার করে আমি এসএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করেছি। ডিজিটাল টকিং বুক আমার মতো দৃষ্টি হারানো কিংবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বদলে দিচ্ছে বই পড়ার ধারণা।
ইপসা’র প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান জানান, ব্রেইল বই হাতে ধরে পড়তে হতো। ব্রেইলে অনেক অসুবিধা ছিল। সব বই ইউনিকোডে পাওয়া যেতো না বলে ব্রেইল করা অসম্ভব ছিল। এখন মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক করা হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক করার জন্য সব বইকে ইউনিকোডে কনভার্ট করতে হয়। ফলে আমাদের ব্রেইল করাটাও সহজ হয়েছে। অর্থাৎ ব্রেইলটা আগে হতো না, কারণ ইউনিকোড ছিল না। মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকের জন্য আমরা পনের হাজার পেইজ ইউনিকোড করেছি, এতে ব্রেইল করাটাও সহজ হয়ে গেছে। প্রতিবছর এখন এনসিটিবি থেকে ব্রেইল দেয়া হয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের। এটা কিন্তু আমাদের এই কাজেরই একটা রেজাল্ট।    
তিনি বলেন, মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকের এখন সবচে’ বড় সমস্যা হচ্ছে ২০২২ সালে সব বই আবার পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। তাই ২০২২ সালের নতুন বইগুলোও যাতে মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকে রূপান্তর করা হয় সেই উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। এনসিটিবি বা সরকারের অন্য কোন প্রতিষ্ঠান মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক প্রতিবছর করার দায়িত্ব এখনো পর্যন্ত নেয়নি। সেজন্য আমরা কাজ করছি। ইপসা ও এটুআই থেকে এখনো পর্যন্ত এটা চালিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রতিবছর নতুন বইগুলো মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকে রূপান্তর করার জন্য কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব নেয়ার সুপারিশ করেন।

আপনি কি মনে করেন?

0 টি পয়েন্ট
উপনোট ডাউনভোট

একটি মন্তব্য

প্রকৌশল সংস্থার প্রধানদের নিম্নধাপে রাখার প্রতিবাদ আইইবির

করোনায় চট্টগ্রামে ৪ জনের মৃত্যু