ভিতরে

ঘরের কালো মেঝেই ছিলো যার ক্যানভাস, এখন তিনি অনলাইনে দাপুটে চিত্রশিল্পী

॥ মামুন ইসলাম ॥
রংপুর, ১৭ জুন, ২০২১ : করোনা ভাইরাসের দাপটে প্রায় দেড় বছর ধরে সমগ্র বিশ্বই যেন থমকে গেছে। বিশ্ব যেখানে অসহায় আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছে, সেখানে সরকারের গৃহীত কিছু পদক্ষেপের কারণে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত দশটি বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম ডিজিটাল বাংলাদেশ। যার সুফল পাচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণ। কেবল দেশের উন্নয়নই নয়, করোনাকালে অনেকের জন্য এই ‘ডিজিটাইজেশন’ আশির্বাদ বয়ে এনেছে। ভাগ্য ফিরিয়েছে রংপুরের চিত্রশিল্পী মোরসালিনা লাভলীর।
বাসসের সাথে আলাপকালে মোরসালিনা বলেন, “বাড়ির কালো মেঝেই ছিল আমার ক্যানভাস। বাবা চক-পেন্সিল ভর্তি বাক্স নিয়ে আসতেন। প্রতি বছর নতুন পাঠ্যপুস্তক পাওয়ার পর গল্প, কবিতা পড়ার আগেই আমি বইয়ের বিভিন্ন ছবি আঁকতাম। আমার মা প্রায়ই বলতেন, আমি আগে আঁকতে শিখেছি, তারপর পড়তে। আসলে শৈশবে সুন্দর কিছু দেখলেই আমি আঁকতে বসে যেতাম।”
মোরসালিনা জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে চাকুরি করার সুবাদে তার বাবা ১৯৯৮ সালে লন্ডন গিয়েছিলেন। সেখান থেকে মেয়ের জন্য রং ও তুলি কিনে আনেন। এই বিষয়টি তাকে আরো অনুপ্রাণীত করে। মোনসালিনা বলেন, “বাবার কাছ থেকে বিদেশী ব্র্যান্ডের রং ও তুলি পেয়ে আমি খুশি ও অনুপ্রাণীত হয়েছি।”
একজন মুক্তমনা ফ্রিল্যান্স শিল্পী ও শিক্ষক মোরসালিনা। এ্যাসপায়ার টু ইনোভেট(এটুআই) ডিজিটাইজেশন কর্মসুচির মাধ্যমে অনলাইনে ছবি এঁকে এবং চিত্রাঙ্কন পাঠদানের মাধ্যমে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন।
ছবি এঁকে, শিশু এবং শিক্ষকদের ছবি আঁকা শিখিয়ে এবং টি-শার্টে বিভিন্ন ছবি এঁকে তা বিক্রি করে প্রতি মাসে গড়ে ৩৫০০০ টাকা আয় করছেন মোরসালিনা। কোভিড-১৯ মহামারি তার কাজে এতটুকু ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। মহামারিকালিন বিশ্বব্যাপি কর্মসংস্থান কমে যাওয়া এবং অনলাইনের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় তার উপার্জন আরো বেড়েছে। পাশাপাশি তিনি একজন সফল গৃহিনীও।
পোট্রেট এঁকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, শুভাকাংখী এবং অন্যান্য শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মুরসালিনার কৌশল। মোরসালিনা বলেন, “চারপাশের সমস্ত কষ্টের মাঝে একটা হাসিমুখের চেহারা আঁকতে যে আনন্দ, তার সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয়না। কোনও ব্যক্তির মুখে হাসি থাকলে আমিও সেটা আঁকতে পছন্দ করি।” জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, এস এম সুলতানসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ছবিও এঁকেছেন মোরসালিনা।
রংপুর শহরের এক সাধারণ পরিবারে মোরসালিনার জন্ম। তিনি ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে সাফল্যের সঙ্গে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে ভর্তি হন। ২০০২ সালে গ্রাফিক্স এবং চিত্রশিল্পে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ১৯৯৭ সাল থেকে নিয়মিতভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের বার্ষিক চিত্র পদর্শনীতে অংশ নিচ্ছেন। ২০০১ সালে জাপানে ‘সেকেন্ড কনটেম্পোরারি নিউ আর্ট এক্সিবিশন ফর ইয়ুথ’-এ তার আঁকা ছবি এবং চিত্র প্রদর্শিত হয়। অন্যান্য ব্যাস্ততা ও পরিবারিক কারণে ১৫ বছর ছবি আঁকার কাজ থেকে দূরে ছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে পুনরায় তিনি ছবি আাঁকা শুরু করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি শিশুদের ছবি আঁকা শেখাচ্ছেন। তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে একটি সিরামিক কোম্পানীতে আর্ট শিক্ষক হিসাবে কাজ করেছেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজড তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, মনিটর এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের সুবিধা নিয়ে তিনি ২০১৮ সালে দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া শুরু করেন।
২০১৮ সালের শেষ দিকে তিনি কলকাতায় আন্তর্জাতিক জলরংয়ের কর্মশালা এবং জয়েন্ট পেইন্টিং প্রদর্শনীতে অংশ নেন। একই বছর শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ফেস্টিভ্যাল,‘ টিউন অব আর্ট ফোকাস বাংলাদেশ,’ এবং ‘বাঁধন ফিফথ ইন্টারন্যাশনাল জয়েন্ট পেইন্টিং এক্সিবিশনে’ তার চিত্রকর্ম ও প্রতিকৃতি প্রদর্শিত হয়।
২০১৯ সালে মোরসালিনার কাজগুলো ইতালিতে ‘ফ্যাব্রিয়ানো ইন্টারন্যাশনাল জয়েন্ট ওয়াটারকালার’ সুইজারল্যান্ডে ওয়াটারকালার সোসাইটি এবং কলকাতার বার্ষিক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী প্রদর্শিত হয়।
নেপালে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল জয়েন্ট পেইন্টিং এক্সিবিশনে ‘২০১৯ সালে বেষ্ট টেন (সেরা দশ চিত্রশিল্পী পুরস্কার’ এ্যাওয়ার্ড পান মোরসালিনা।
গত বছর তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল পেইন্টিং এক্সিবিশনে অংশ নেন। চারু কলায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর মোরসালিনা ‘মাদার তেরেসা শাইনিং পারসোনালিটি এ্যাওয়ার্ড ২০২১’ লাভ করেন।
বিভিন্ন পোট্রেট ও অন্যান্য ছবিসহ ফেসবুকে প্রতিদিন তিনি ডায়েরি লেখেন।
সম্প্রতি তিনি রংপুরের ইমেজ অ্যাডভান্সড টিচার্স ট্রেনিং কলেজের চারুকলা ও কারু শিল্পের একজন শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন। মহামারীকালীন সময়ে সর্বনিম্ন স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষক এবং অন্যান্যরা এই কলেজে অনলাইনে পড়াশোনা করছেন।‘মোরসালিনা চারুকলা একাডেমি’ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং স্থানীয় পণ্য নিয়ে কাজ করা নারী উদ্যোক্তাদের ঢাকা ভিত্তিক একটি অনলাইন গ্রুপ ‘হার-ই ট্রেড’ এর মাধ্যমে শিশুদের মহামারীর মধ্যে অনলাইনে আঁকতে শেখাচ্ছেন।
মোরসালিনার অনলাইন ক্লাসের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ঢাক কেন্দ্রিক। তিনি বলেন, বাচ্চাদের আঁকতে শেখানো এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে একই শিক্ষা দেয়ার মধ্যে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে।
তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি’র শিশু সুরক্ষা কর্মসূচির প্রকল্পগুলোতেও অনলাইনেও কাজ করছেন। জল রং, পারিবারিক প্রতিকৃতি এবং কফি পেইন্টিং, স্বামীর প্রতিকৃতি, হাসি মুখের সিরিজ বা প্রিয় বন্ধুদের স্কেচগুলিতে সাদা ফুলের শুভ্রতা এমন ভিন্ন ভিন্ন থিম নিয়েইই তার অনলাইন কাজ চলছে।
পেশাগত দায়িত্ব পালনে এবং ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বা একজন মহিলা হিসাবে অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করতে কখনো কোন বাধার সম্মুখীন হননি বলে জানান মোরসালিনা।
এ ক্ষেত্রে তিনি সব সময়ই পারিবারের সহযোগিতা বা সমর্থন পেয়েছেন। এমনকি বিয়ের আগেও বাবা-মা এবং অন্যান্য সকলের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছেন। বিয়ের পর তার শ্বশুর-শাশুড়ি এবং বিশেষ করে তার স্বামী মাহবুবুল আহসান বলেছিলেন চিত্রকর্ম করে সংসার চালাতে কোন সমস্যা নেই।
মোরসালিনা জানান, কাজের প্রয়োজনে সংসারের সবাই সহযোগিতা করেন। ঘরের কাজে যাতে কোন সমস্যা না হয় সে জন্য তার স্বামী একটি আলাদা ষ্টুডিও বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি অনলাইন ক্লাসেও সহযোগিত করেন। কোভিড-১৯এর কারণে অনেক মানুষ চাকুরি হারালেও মোরসালিনার কাজ আরো বেড়েছে।
বর্তমানে মেসেঞ্জার, ফেসবুক, হোয়াটসআ্যাপ এবং বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে দেশ-বিদেশ থেকে অনলাইনে তিনি আরো বেশি অর্ডার পাচ্ছেন। ইন্টারনেট ব্যবহার করে মোরসালিনা বহু মানুষের টি-শার্টে তাদের ছবি আঁকেন। ছবিগুলো ৪ থেকে ২০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য ছবির দাম বিভিন্ন মাত্রার ওপড় নির্ভর। ছবি আাঁকার বেশিরভাগই উপকরণই ঢাকা শহর থেকে কিনতে হয়। তাই এ অতিমারির সময় উৎপাদিত পণ্য চলবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিতই থাকতে হয় তাকে।
শৈশব থেকে বাবার অনুপ্রেরণায় শিল্পী হয়ে ওঠেন মোরসালিনা। আর বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে মোরাসালিনাও পরিতৃপ্ত। ২০২০ সালে মৃত্যুর আগেই তিনি দেখে গেছেন তার মেয়ের কাজের বৈশ্বিক স্বীকৃতি।
রংপুর শহরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী স্বামী মাহবুবুল হাসান এবং তাদের একমাত্র কন্যা জারা জেনিতা আহসা কে নিয়ে মোরসালিনা সুখেই আছেন। তবুও শিল্পীর তৃষ্ণা আমৃত্যু।
বড় পরিসরে একটি একক প্রদর্শনীর স্বপ্ন দেখেন মোরসালিনা। পাশাপাশি রয়েছে নিজস্ব একাডেমিকে মানে ও গুণে আরো বড় করে তোলার স্বপ্ন।

আপনি কি মনে করেন?

0 টি পয়েন্ট
উপনোট ডাউনভোট

একটি মন্তব্য

রাঙ্গুনিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা লোকমানুল হকের ইন্তেকালে তথ্যমন্ত্রীর শোক

জনজীবন অতিষ্ঠ করে শহরকে বিপর্যস্ত করার অধিকার কারো নেই : স্থানীয় সরকার মন্ত্রী