ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্য সাহেলা হেমরন (৩০) তার পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মরাবস্তাপুকুর এলাকায় সরকারি খাস জমিতে একটি খুঁপড়ি ঘরে গত ১৫ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন।
সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনকালে হেমরন বাসস’কে জানান, এই জরাজীর্ণ খুঁপড়ি ঘরেই তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়েছে।
তিনি বলেন ‘আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা-জমি নেই। ফলে এই সরকারি খাস জমিই আমাদের একমাত্র ভরসা। আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকেই এখানে বসবাস করে আসছি।’ হেমরন তার জরাজীর্ণ ঘরটি দেখিয়ে বলছিলেন প্রতিবছর দফায় দফায় বৃষ্টি ও ঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ঘরটি ।
এই মরাবস্তাপুকুর এলাকায় শুধু হেমরন নন, তার মতো আরো ৫০টি সাঁওতাল পরিবার একইভাবে যুগের পর যুগ বসবাস করে আসছে, যাদের নিজেদের কোনো জায়গা-জমি নেই এবং দিন মজুর হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
ঠিক কত বছর যাবৎ এই সাঁওতাল পরিবারগুলো এই এলাকায় বসবাস করছে, এর সঠিক কোনো দিন-ক্ষণ বলতে পারেন না। কিন্তু এই মরাবস্তাপুকুর এলাকায়ই তার এবং তার পিতা-মাতার জন্ম হয়েছে বলে হেমরন জানান।
তিনি বলেন, এই পরিবারগুলোর সবাই দিন মজুর, তাই তাদের পক্ষে পরিবারের খরচ চালিয়ে জায়গা-জমি ক্রয় করা খুবই কঠিন।
হেমরন তার সংসারের আর্থিক টানা-পোড়েনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমার স্বামী সুনিল সরেনও একজন দিন মজুর। অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালান। ফলে পাঁচ সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণের খরচ মিটিয়ে আমাদের পক্ষে জায়গা-জমি ক্রয় করা বা নতুন ঘর তৈরি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।’
যা-হোক, হেমরন এখন সেই সব ভাগ্যবানদের একজন যারা দুই শতক জমির মালিকানাসহ স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে একটি আধা-পাকা ঘর পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী গত ২৩ জানুয়ারি সারাদেশে ৬৯ হাজার ৯শ’ ৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের কাছে ঘর হস্তান্তর করে। হেমরনসহ মরাবস্তাপুকুর এলাকায় বসবাসরত ৫০টি সাঁওতাল পরিবারের প্রত্যেককেই দুই শতক জমির মালিকানাসহ একটি করে আধা-পাকা ঘর উপহার দেন।
প্রত্যেক ঘরে রয়েছে দু’টি করে শয়ন কক্ষ, একটি রান্নাঘর, একটি সংযুক্ত টয়লেট ও একটি উন্মুক্ত বারান্দা। ঘরের মেঝে পাকা, ওপরে টিনের চাল।
‘আমাদের নিজেদের জায়গা থাকবে, আধা-পাকা ঘরে ঘুমাবো; এটা তো আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু আমাদের প্রাণ প্রিয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। আমরা তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ।’ নতুন ঘর পেয়ে আনন্দাশ্রু মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন হেমরন।
হেমরনের মতো ৬৫ বছর বয়সী সরদার সরেনও একই সাথে একটি ঘর পেয়েছে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের এই বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি তার জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই কাটিয়েছেন একটি খোঁপড়ি ঘরে। শেষ জীবনে এসে তিনিও প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় খোঁজ পেয়েছেন স্থায়ী ঠিকানা।
আবেগাআপ্লুত সরদার সরেন চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, “এই ঘরটি আমার কাছে শুধু একটি ঘর নয়। এটি একটি স্বপ্ন। একটি স্থায়ী ঠিকানা। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে, নিজ ঘরে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য।”
সাঁওতাল পরিবারের সদস্যদের দেয়া ঘরগুলো সমতল ভূমিতে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিনে তৈরি করা হয়েছে। ‘মুজিব বর্ষে’ কেউ গৃহহীন থাকবে না কর্মসূচির আওতায় এসব ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাম কৃষ্ণ বর্মণ জানান মরাবস্তাপুকুর এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ৫০টি পরিবারসহ তার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মোট ৭০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের প্রত্যেককে একটি করে আধা-পাকা ঘর উপহার দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন এই পরিবারগুলোর জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে এবং অবশিষ্ট ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারগুলোকে এই প্রকল্পের আওতায় আনার জন্য কাজ করছেন তারা।
আশ্রয়ণ প্রকল্প সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো: তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমতলে বসবাসরত সাড়ে তিন হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারকে ’মুজিব বর্ষের উপহার’ হিসেবে একটি করে ঘর দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি তাদের স্কুলগামী শিশুদের বাইসাইকেল এবং শিক্ষাবৃত্তি দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা সহজে শিক্ষা লাভ করতে পারে।
তিনি জানান, তিন পার্বত্য জেলা -রাঙ্গামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়িতে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারগুলোকেও একই ধরনের ঘর উপহার দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় মোট ৪ হাজার ৫শ’ পরিবারের কাছে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানান তোফাজ্জল হোসেন।
ভিতরে জাতীয়
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গাইবান্ধায় স্থায়ী ঠিকানা পেলো ৫০ সাঁওতাল পরিবার
